মার্চের শেষেই দৃশ্যপট বদলে গেছে, করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পূর্ববর্তী সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ছে। গত বছর মার্চে দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর সরকার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। দীর্ঘ ছুটি ঘোষিত হয়। সে সময়ে মানুষ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই করোনার ঝুঁকির বিষয়টি অনুধাবন করেছে এবং কড়াকড়িভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছে। সে সময়ে যানবাহনের চলাচল যথেষ্ট সীমিত হয়ে পড়ে, মানুষও একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হতো না। অথচ গত বছরের তুলনায় করোনার সংক্রমণ ও শক্তির তীব্রতা বাড়লেও মানুষের ভেতরে আগেকার সেই সংযত ভাব, কঠোরতা ও করোনাভীতি দেখা যাচ্ছে না। আদৌ দেশে করোনা আছে বলেই মনে হচ্ছে না। কেননা মানুষ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান করছে, সভাসমিতিতে যোগ দিচ্ছে, বেড়াতে বেরুচ্ছে দল বেঁধে। এমন নয় যে মানুষ এক বছর ধরে করোনার সঙ্গে বসবাস করে অনেকটাই গায়ে সয়ে নিয়েছে। প্রকৃত অবস্থা হলো মানুষের গা ছাড়া ভাব। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ করোনার ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে। প্রথম ডোজ নিয়েই তারা ভাবছে যে করোনাপ্রুফ হয়ে গেছে। তাদের আর করোনা হবে না। আবার অনেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে, যেহেতু এক বছরে তাদের কোভিড ১৯ হয়নি। অনেকেই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে যে তার ভেতরে যথেষ্ট প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে তাই করোনা তাকে কাবু করতে পারবে না। কিন্তু করোনার নতুন যে ধরনটি এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে তাতে শুধু বয়স্ক মানুষই নয়, তরুণ-যুবারাও আক্রান্ত হচ্ছে এবং বেশ কাহিল হয়ে পড়ছে। নিয়মিত ব্যায়ামচর্চা করা স্বাস্থ্যবান তরুণেরা পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর শ্বাসকষ্টে ভুগছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক। ইতোমধ্যে সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে দেখা দিয়েছে শয্যা সঙ্কট। এআইসিইউ বেড পাওয়া দুষ্কর। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমরা দফায় দফায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। গত এক বছরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আরও দৃশ্যমান উন্নতি প্রত্যাশিত ছিল। রাতারাতি হাসপাতাল গড়ে তোলা যায় না, তবে সাময়িকভাবে করোনা মোকাবেলার জন্য ডাক্তার-নার্সদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করা এবং একই সঙ্গে সাময়িকভাবে সকল সুবিধাসম্পন্ন চিকিৎসাকেন্দ্র বাড়ানোর সুযোগ ছিল। বইমেলা বলে নয়, করোনাকালে সব ধরনের মেলার আয়োজনই ঝুঁকি বাড়াবে এটি স্বাভাবিক। শপিং মল ও ছোট-বড় বাজারেও ব্যাপক জনসমাগম ঘটে। তাই এসব স্থানেও স্বাস্থ্যবিধির কঠোরতা কাম্য। বইমলো বরং খোলা জায়গা এবং যথেষ্ট জায়গা জুড়ে চলছে। মেলাতে মাস্ক পরাও বাধ্যতামূলক। তারপরও সরকার মেলার সময় সংক্ষিপ্ত করে সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ মেলার এই পরিবর্তিত সময় সাড়ে তিন ঘণ্টা দুপুরে নয়, বিকেল থেকে শুরু করলেই সমীচীন হতো। বিভিন্ন মহল থেকে এ ব্যাপারে যে দাবি উঠছে সেটি অবশ্যই যৌক্তিক। তাছাড়া পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ করাও সুবিবেচনাপ্রসূত। করোনাকালে আগে থেকে পর্যটনকেন্দ্রে জনসমাগম সীমিত রাখার ব্যবস্থা নেয়া হলে যুক্তিযুক্ত হতো। অপরদিকে গণপরিবহনে যাত্রী কমিয়ে ভাড়া বাড়ানোর ব্যবস্থা নেয়া হলেও এখানে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। বলাবাহুল্য, গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া এ সমস্যার সমাধান হবে না। কেননা কর্মস্থল ও অন্যান্য প্রয়োজনে যত সংখ্যক যাত্রী গণপরিবহন ব্যবহার করত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেখানে সংখ্যার কোন হেরফের ঘটছে না। করোনা মোকাবেলায় সব দায়িত্ব সরকারের ওপর না চাপিয়ে সামাজিক উদ্যোগের সুযোগও কাজে লাগানো চাই। সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সাধারণ বিত্তহীন ও ভাসমান মানুষের কাছে মাস্ক পৌঁছে দিতে পারে। শুধুমাত্র সঠিকভাবে মাস্ক পরিধান এবং পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখলেই করোনার সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব। আমরা করোনা পরীক্ষা আরও সুলভ ও সুগম করার পক্ষে। করোনা পজিটিভ হলে অনেকের মাথাতেই বাজ ভেঙ্গে পড়ে। জরুরী ভিত্তিতে তার চিকিৎসা সেবার প্রয়োজন পড়ে। কড়াকড়িভাবে তার সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টাইনের প্রয়োজন পড়ে। এসব তথ্যপ্রদান ও সেবা নিশ্চিত করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে উদ্যোগ ও সক্রিয়তা চাই। সেজন্য ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয়ার কোন বিকল্প নেই। সঠিকভাবে করোনা মোকাবেলা করতে সমর্থ হলে মৃত্যুঝুঁকি এড়ানো যায়। তাই রোগ ব্যবস্থাপনার ওপর আামাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। একইসঙ্গে সরকারঘোষিত ১৮ নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা চাই।
Leave a Reply